প্রধান অতিথীর বক্তব্যে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আলহাজ্ব আব্দুল আজিজ বলেন -” বাংলাদেশ এখন ডেমোগ্রাফিক ডেভিডেন্টের মধ্যদিয়ে অতিক্রম করছে। এই সময়ে শিক্ষা, সচেতনতা, স্বাবলম্বীতা, শান্তি প্রতিষ্ঠা, সম্প্রীতি সুরক্ষা, মর্যাদা নিয়ে জীবনকে প্রতিষ্ঠা, নিরাপত্তা, বৈচিত্র্যতা প্রভৃতি বিষয়ে তরুণদের এগিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশের ইতিহাসে তরুণরাই সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে সমস্যার সমাধান করেছেন। এমতাবস্থায় তরুণরা ব্যাতিত দেশের সামগ্রীক উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব নয়। তরুণ-তরুণীদের ইতিবাচক নেতৃত্ব ও পদক্ষেপ অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে ত্বরান্বিত করবে। আমাদের নাগরিক অধিকার ভোগের পাশাপাশি অবশ্যই নাগরিক দায়িত্বের জায়গায় সচেতনভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট বাস্তবায়নের সুচনাতেই বলা হয়েছে কেউ পিছিয়ে থাকবে না। তাই আমাদের সবাইকে নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে, যেখানে প্রত্যেক মানুষ মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকবে এবং কোন সাম্প্রদায়িক চেতনা বা জঙ্গিবাদের ধারণা আমাদের গ্রাস করতে না পারে। এটাই হোক তরুণ সমাজের কাছে আমাদের নিবেদন “
পিস প্রেসার গ্রুপ গুরুদাসপুর উপজেলার আয়োজনে ১৯ এপ্রিল ২০১৮ পল্লী উন্নয়ন একাডেমী মিলনায়তনে শান্তি ও সম্প্রীতির আহবানে তারুণ্যের সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে। শিক্ষাবিদ ও সমাজকর্মী এফএফ মোবারক আলীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত তারুণ্যের সংলাপে প্রধান অতিথী হিসেবে উপস্থিত ছিলেন গুরুদাসপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আলহাজ্ব আব্দুল আজিজ। বিশেষ অতিথী হিসেবে যথাক্রমে উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান শাহিদা আক্তার মিতা, মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রাজ্জাক, চাঁচকৈড় নাজিমউদ্দিন স্কুল এণ্ড কলেজের অধ্যক্ষ জয়নাল আবেদীন দুলাল, পেইভের মাস্টার ট্রেনার এএইচএম একরামুল হক খোকন, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আব্দুল মান্নান মুকুল, বেগম রোকেয়া স্কুল এণ্ড কলেজের সাবেক শিক্ষক আনোয়ারা বেগম, সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান রোকসানা পারভীন, গুরুদাসপুর প্রেসক্লাবের সভাপতি ও পিপিজি এম্বাসেডর শাহজাহান আলীপ্রমূখ। তারুণ্যের সংলাপে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন গুরুদাসপুর উপজেলা পিপিজির সমন্বয়কারী হাবিবুর রহমান জালাল।
অংশগ্রহণকারী শহীদ শামসুজ্জোহা সরকারী কলেজ, বিলচলন কারিগরী কলেজ, রোজী মোজাম্মেল মহিলা কলেজ হতে আগত শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে নিজের মতামত ব্যক্ত করতে গিয়ে শিক্ষার্থী মাহফুজুর রহমান বলেন “ সৃষ্টিতত্ত্বে মানুষে মানুষে কোনো পার্থক্য নেই। আকৃতি-প্রকৃতি, সুখ-দুঃখ, ক্ষুধা-তৃষ্ণা, আহার-বিশ্রামের অনুভূতিতে সব মানুষ অভিন্ন। পৃথিবীর যেকোনো দেশের অধিবাসী হোক, মানুষের একমাত্র পরিচয় হলো সে মানুষ। সবার উপরে মানুষ সত্য– এটিই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মূলমন্ত্র। মানুষ এই সত্যকে ভুলে কৃত্রিম জাতি ও ঘৃণ্য জাতিভেদ তৈরি করেছে। ভেদবুদ্ধিতে প্রণোদিত হয়ে গড়ে তুলেছে বিভেদের দুর্ভেদ্য প্রাচীর। কিন্তু সেই অসংখ্য বর্ণ-বৈচিত্র্যের মাঝে অতীতের মতো আজও মানুষ বহন করে চলছে এক ও অভিন্ন রক্ত এবং মানব ঐতিহ্য। আমরা আজকের সংলাপের মধ্যদিয়ে সবাইকে মানুষ হিসেবে বিবেচনায় আনতে চাই।”
শিক্ষার্থী সাদিয়া আফরোজ মীম বলেন “ সমাজবদ্ধ মানুষ নানা ধর্ম-সম্প্রদায়ে বিভক্ত। কিন্তু ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতা এক নয়। পৃথিবীর সকল ধর্মের মূলকথা প্রেম, মৈত্রী, শান্তি ও সম্প্রীতি। এই শিক্ষা থেকে সরে এসে এক সম্প্রদায়ের প্রতি অন্য সম্প্রদায়ের বিদ্বেষ বা আক্রোশই সাম্প্রদায়িকতা। সাম্প্রদায়িকতার নগ্ন প্রকাশ মানুষকে পশুতে পরিণত করতে পারে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে শুধু সাম্প্রদায়িকতার কারণে হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে। দারুণভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে মানবতা। সাম্প্রদায়িকতা তাই মানুষের যুগ-যুগান্তের অভিশাপ। আমরা আজকে জানলাম আমরাই বাংলাদেশকে সংঘাতের দিকে ঠেলে দিচ্ছি, এঅবস্থা থেকে নিজের পরিবার এবং এলাকাকে আমরাই সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত স্থাপন করবো”
একটিভ সিটিজেনস জান্নাতুন নেছা জান্নাত বলেন-“আমরা ইতিহাস থেকে জেনেছি পৃথিবীতে মানুষের আগমনের সূচনাপর্বে কোনো ধর্ম, বর্ণ, জাতি, গোত্রভেদ ছিল না। ফলে তখন তাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার উন্মেষ ঘটেনি। পরবর্তীতে মানুষ যখন সমাজ, রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করল, তখন থেকে আত্মস্বার্থের কারণে ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম, জাতি, বর্ণভেদ, গোত্র ইত্যাদির প্রকাশ ঘটল। জাতিবিদ্বেষের তীব্র বিষ ছড়িয়ে পড়ে দিকে দিকে, দেশে দেশে। বিশেষ করে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে এই জাত্যভিমান ছিল সবচেয়ে বেশি। উপমহাদেশে মুঘল আমলে দোল খেলাকে কেন্দ্র করে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে দাঙ্গা হয়েছিল। ব্রিটিশ শাসকরা হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিবাদ বাধানোর চেষ্টা করেছিল। নিজেদের ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য এবং হিন্দু-মুসলমান যাতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে পরবর্তীতে আন্দোলন করতে না পারে। ১৯২২ থেকে ১৯২৭ এই কয়েক বছরে একশটিরও বেশি দাঙ্গা ঘটেছিল। ১৯৩০ থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত প্রতিবছরই হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা হয়েছে। পরবর্তীতে ভারতে ছোট-বড় অনেক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে।”
শিক্ষার্থী ইশরাত জাহান ঈশিতা বলেন-” সাম্প্রদায়িকতা মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও জাতীয় উন্নতির অন্তরায়। মানুষের সভ্য, সুস্থ ও শান্তিময় জীবনকে নষ্ট করে। মানুষকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়। হীন সাম্প্রদায়িকতার মূল নিহিত আছে বিভিন্ন ধর্মের গোঁড়ামি ও অন্ধবিশ্বাসের ওপর। আমরা মানসিকতা পরিবর্তন
না করলে দেশের গুণগত পরিবর্তন সম্ভব নয়।”
শিক্ষার্থী আতিকুর রহমান বলেন- “ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রেখেই এদেশে ধর্মীয় ও সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। এভাবে বাংলাদেশকে বিশ্বে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অন্যতম পীঠস্থান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে যে গভীর সংহতি ও ঐক্য তা জাতীয় ইতিহাসে গৌরবময় ঐতিহ্য হয়ে আছে। বহুকাল থেকেই এদেশের মানুষ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রেখে চলছে। বাঙালি হিন্দু-মুসলমানরা একত্র হয়ে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন করেছে। ১৯৭১ সালে এদেশের হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খ্রিস্টান, বাঙালি-অবাঙালি সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।”
শহীদ শামসুজ্জোহা সারকারী কলেজের প্রভাষক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন -” জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় ক্ষেত্রেই উন্নতি ও সমৃদ্ধির জন্য অসাম্প্রদায়িক চেতনার ব্যাপক বিকাশ দরকার কারণ কোনো দেশে সাম্প্রদায়িক সুসম্পর্ক বজায় না রেখে কোনো উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। জাতীয় অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অপরিহার্য। কাজেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিকাশের বিকল্প নেই। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিকাশের জন্য পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, আন্তরিক মেলামেশো, পরোপকারী মনোভাব, ধর্ম-বর্ণ, জাতি-গোত্র ভেদ উপেক্ষা করে একই স্রস্টার সৃষ্টি বলে এবং একই দেশের লোক বলে নিজের মানুষ হিসেবে এক জাতি মনে করা উচিত। কালো-সাদার ব্যবধান দূর করে পরস্পর স্নেহ-মমতার বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া, নিজের মধ্যে সুকুমার বৃত্তির লালন করা, সব ধর্মের সারবস্তু সম্পর্কে সঠিক তত্ত্বজ্ঞান অর্জন করা, কল্যাণব্রতী হয়ে সব মানুষের জন্য কাজ করা দরকার। আত্মীয়-অনাত্মীয় নয়, সব মানুষকে ভাই মনে করা উচিত। আর এগুলো চর্চার মাধ্যমেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিকাশ ঘটে। আমি দেখতে চাই আমার শিক্ষার্থীরা দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।”
পিপিজি মাস্টার ট্রেনার এএইচএম একরামুল হক খোকন বলেন -” এই পৃথিবী জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষেরই বাসভূমি। পৃথিবীতে বাইরের চেহারায় মানুষের মধ্যে সাদা-কালো ব্যবধান থাকলেও সব মানুষের ভেতরের রং এক এবং অভিন্ন। তবু মানুষ জাতিভেদে, গোত্রভেদ, বর্ণভেদ, বংশকৌলীন্য ইত্যাদি কৃত্রিম পরিচয়ে নিজেদের মানুষ পরিচয়টিকে সংকীর্ণ ও গণ্ডিবদ্ধ করে ফেলে। কিন্তু সারাবিশ্বের সঙ্গে মানুষের যে সম্পর্ক সেই বিচারে মানুষের আসল পরিচয় হচ্ছে সে মানুষ। তাই দেশে দেশে, মানুষে মানুষে ধর্ম ও বর্ণের পার্থক্য সৃষ্টি করে মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা উচিত নয়। আমাদের প্রতিটি নাগরিকের প্রধান কর্তব্য হলো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধনকে মজবুত করে সুপ্রতিষ্ঠিত করে তোলা। তাতেই সবার কল্যাণ ও মঙ্গল নিহিত। আজকের পর গুরুদাসপুর উপজেলার চিত্র বদলাবে এটা আশা করছি।”
মুক্তিযোদ্ধা ও শ্রমিক লীগ নেতা আব্দুর রাজ্জাক বলেন -” ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি ভিন্ন ভিন্নভাবে মানুষের মর্যাদার বিষয়টিকে বোঝে বা অনুধাবন করে থাকে। মানুষের মর্যাদা বলতে কি কাউকে সম্মান দেখানো বোঝায়? কেবল এইটুকুই না। সম্মান বা মান্য করার বিষয়টি সমাজের অবস্থাগত পার্থক্যসূচক বিষয়ের সঙ্গে জড়িত। সম্পদ অথবা কৃতিত্বের ওপর ভিত্তি করে এই অবস্থান বা পদমর্যাদা নির্ধারণ করা হয়। সম্মান বিষয়টি নৈতিক আচরণের কিছু মানদণ্ডের সঙ্গেও সম্পর্কিত থাকতে পারে। যার জন্যই আমরা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিলাম। তরুণ প্রজন্মের কাছে আমার আবেদন, প্রতিদিন অন্ত:ত একটি ভালো কাজের অভ্যাস করতে হবে।”
চাঁচকৈড় নাজিমউদ্দিন স্কুল এণ্ড কলেজের অধ্যক্ষ ও পিপিজি এম্বাসেডর জয়নাল আবেদীন দুলাল বলেন –” ক্ষমতা একটি আপেক্ষিক বিষয়। হতে পারে একজন নারীর জন্য তার নিজ কাজের পরিবেশে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও প্রভাব বিস্তারের যথেষ্ট ক্ষমতা আছে। কিন্তু নিজ ঘরের মধ্যে হয়তো তার ক্ষমতা খুবই কম। একজন দরিদ্র ও শিক্ষাবঞ্চিত পুরুষ নিজের জন্য কাজ খুঁজে বের করতে এবং সমাজের অন্যান্য মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠায় হয়তো সক্ষম হচ্ছে না। কিন্তু যখন সে পরিবারের কর্তা এবং পরিবারের সকল বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের কর্ণধার, তখন হয়তো তিনি সক্ষম। তাহলে মর্যাদা আসলে কী? মর্যাদা নির্দেশ করে এমন কিছু, যেটি সকল মানুষের মাঝে উপস্থিত, যা মানুষের ‘অন্তর্নিহিত ক্ষমতা’ অথবা কল্পনা, স্বপ্ন এবং প্রত্যাশা করার শক্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত। আমরা আজ প্রত্যাশা করতেই পারি সবাই মিলে গুরুদাসপুরকে আলোকিত এলাকা উপহার দিতে পারবো।”